কুড়িগ্রামে ছিটমহল বিনিময়ের ৯ বছর, পাল্টেছে বিলুপ্ত ছিটমহল

আনোয়ার সাঈদ তিতু,
কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:
র্দীঘ ৬৮টি বছর অন্ধকারের জীবন থেকে মুক্তির কথা চিন্তা করাই ছিল স্বপ্ন। এক কথাই বন্দিদশায় জীবন-কাঁটতো তাদের। ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা চলাচলের কোনো রাস্তাঘাটই ছিল না। নদী, খাল, ডোবা এমনকি জমির আইলের ওপর দিয়ে মানুষজন কোনোমতে যাতায়াত করত। চুরি চাপটা করেই পরিচয় গোপন রেখে কিছু বাসিন্দা বাংলাদেশের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পড়াশুনা করেছে। কিছু মানুষ পরিচয় গোপন করে ভয় ভয় করে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা নিয়েছেন। এভাবেই তাদের যুগের পর যুগ অবরদ্ধ জীবন কাটাতে হতো। সেই সোনালী স্বপ্ন মাত্র ৯ বছরেই অবসান ঘটেছে সাবেক ছিটমহল বাসিন্দাদের। নাগরিকত্ব পাওয়ার ৯ বছরে ছিটমহলবাসীরা পেয়েছেন আধুনিক ও উন্নত মানের জীবন-যাপনের ছোঁয়া।
আজ সেই ঐতিহাসিক ৩১ জুলাই। ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের ৯ বছর। ২০১৫ সালের এ দিনে মধ্য রাতে দুদেশে থাকা ছিটমহলগুলো স্ব-স্ব দেশের মূল ভূ-খন্ডের সাথে সংযুক্ত হয়। সমাপ্তি ঘটে ১৬২ ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দিদশা। ছিটমহল বিনিময়ের পর থেকেই বঞ্চিত এ মানুষগুলোকে মূলধারায় যুক্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। এই ৯ বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে ছিটমহলগুলোর। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সামাজিক নিরাপত্বার মতো নাগরীকের মৌলিক অধিকারের সবকিছুই পুরন করেছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য ছিটমহল গুলোর মতো উন্নয়ন ঘটেছে দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া ছিটমহলেও। উন্নয়নের ছোয়ায় পাল্টে গেছে দাসিয়ার ছড়াবাসীর জীবন চিত্র।
র্দীঘ ৯ বছরে বদলে গেছে প্রতিটি মানুষের জীবন। ছিটমহল এখন শুধুই ইতিহাস ও অতীত স্মৃতি।
নবমতম বর্ষে পর্দাপনে এই ঐতিহাসিক দিনটি ধরে রাখতে এবারেই প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাবে বিলুপ্ত ছিটমহল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। প্রতি বছরের ন্যায় মঙ্গলবার ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে কালিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৬৮টি মোমবাতী প্রজ্জ্বলন শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন করা বলে জানিয়েছেন সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা।
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহলের সবচেয়ে বড় এবং আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেড কাউন্টিং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪ টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে পৌছে গেছে বিদ্যুৎ। ৫৮ কিমি নতুন লাইনে সংযোগ দেয়া হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি পরিবারকে। পাকা করা হয়েছে ৪০ কিলোমিটার সড়ক। নির্মান হয়েছে ১টি ৩৬ মিটারের ব্রিজসহ ৫ ব্রিজ ও বেশকিছু কালভার্ট। স্থাপিত হয়েছে তিনটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও ভূক্ত হয়েছে ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক। মসজিদ, মন্দিরসহ রিসোর্স সেন্টার। ডিজিটাল আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার, এছাড়ার শতভাগ সেচের আওতায় আনা হয়েছে কৃষি জমি। হাজারও পরিবারে ভিজিডিসহ শতভাগ বাড়িতে নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় পানি ও সেনিটেশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। সেখানকার বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও স্মার্টকার্ড। এসব উন্নয়নে জীবনচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার মানুষের।
ছিটমহলের বাসিন্দা দেলোয়ার খাঁন ও আলতাফ হোসেন জানান, এই ছিটমহলে অনেক জঙ্গল জার ও দস্যু ডাকাত ছিল। ছিল না কোন রাস্তা ঘাট। আমরা কি কষ্টে যে এখানে বসবাস করেছি একমাত্র আল্লাহ জানে। আমাদের ৬৮ বছরের দুঃখ কষ্টগুলো শেখ হাসিনা সরকার সকল নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে এবং সরকার আমাদের অনেক উন্নয়ন করেছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন শেখ হাসিনাকে স্বরণ করবো।
ছিটমহল দোলাটারী এলাকার বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, কোন দিন ভাবিনি আমরা অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পাবো। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে শেখ হাসিনা সরকার। আজ আমার ছেলে বিজিবিতে চাকুরী করছেন। শুধু আমার ছেলেই নয় ছিমহলের অনেকেই ১ জন আর্মি, ৩ জন বিজিবি ও ৫ জন পুলিশ এবং ১ জন পুলিশ সাজেন্টসহ অনেকেই ভাল ভাল স্থানে ও চাকরি করছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমি গর্বের সহিত বসবাস করছি। তাই যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর দোয়া কামানা করেই যাবো।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় বাংলাদেশ অংশের দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খাঁন জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী টানা ৯ বছরে ছিটমহলের রাস্তা,ঘাট, ব্রিজ-কালভাট,স্কুল-কলেজ,ঘরে ঘরে বিদ্যুতসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আমরা জীবনে ভাবিনি এতো উন্নয়নের ছোঁয়া পাবো। এই দুই নেতা আরও জানান, ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলাদেশ থেকে ৬৫টি পরিবারের ১০৭ জন হিন্দু এবং ১০০ জন মুসলিম ভারতে যায়। আমাদের এই কালিরহাট বাজারে একটি মসজিদ আছে। তার ঠিক ১০০ গজ দূরে একটি বড় মন্দির আছে। যে যার ধর্ম পালন করছে। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মুসলিম-হিন্দু মিলে অনেক ভালো আছি। বর্তমান সরকার আমাদের ভালো রেখেছে। তাই এই সরকারের র্দীঘায়ু কামনা করছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রেহেনুমা তারান্নুম জানান, ২০১৫ সালের মধ্য রাতে দাসিয়ারছড়া ছিটমহলটি বিনিময় হয়। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছওে সাবেক ছিটমহলে স্কুল-কলেজ,রাস্তা-ঘাট ও প্রতি ঘরে ঘরে বিদ্যুত সুবিধাসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সরকারের সু-নজর আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ছিটমহলবাসীদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত জানালেন ইউএনও।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর থেকে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে যে রাজা ও জমিদারদের দাবা পাশা খেলায় তালুক/ মৌজা বাজি ধরার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে যে ছিটমহলের উৎপত্তি ঘটে, সেই ছিটমহলবাসী নাগরিত্বহীন হয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঐতিহাসিক ‘মুজিব-ইন্দিরা’ স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পায় এবং সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন