বিজ্ঞাপন
ফুলবাড়ীতে বাল্যবিবাহকে না বলা ৩ জন মেয়ের জীবন কাহিনি
বিজ্ঞাপন
মোস্তাফিজার রহমান জাহাঙ্গীর
স্টাফ রিপোর্টার:
বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে বাল্যবিবাহ দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপ। পৃথিবীর যে কয়টি দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১২-১৮ বছরের মধ্যে। এসব বাল্যবিবাহের অধিকাংশ কারণ হচ্ছে- দরিদ্রতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তার অভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক এবং বাল্যবিবাহ রোধ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন রকম কর্মসূচিও পরিচালনা করছে। তবুও বাল্যবিবাহ অব্যাহত আছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ৭৫ ভাগ কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বালকদের মধ্যে এই হার কিছুটা কম। এই বাল্যবিবাহের মূলে আছে সুপাত্র প্রাপ্তি, দরিদ্রতা এবং যৌন হয়রানির ভয়। নানা ধরনের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না।
মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি (এমজেএসকেএস) এর তথ্য অনুযায়ী বাল্যবিবাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া উপজেলার ৩ মেয়ের জীবন কাহিনী।
১ / খাদিজা আক্তার(১৬)পিতা আব্দুল খালেক, মাতা মৃত আরজিনা বেগম,গ্রাম চরখাটামারি, বড়বাড়ী, লালমনিরহাট। খাদিজার বয়স যখন ৮ বছর খেলা ধুলা করার সময় ঠিক তখনই তার জীবনে নেমে আসে ঝড়। তার মাকে গলা টিপে হত্যা করে তার পাষন্ড পিতা। তখন খাদিজাকে নিয়ে যায় তার নানি,দেড় মাস পর তার নানিও মারা গেলে খাদিজার এক মাত্র খালা খাদিজাকে নিয়ে আসে ফুলবাড়ী উপজেলার সদর ইউনিয়নের প্রাণকৃষ্ণ গ্রামের মুকুল ইসলামের অভাবি সংসারে। খাদিজাকে ভর্তি করে দেয় স্কুলে। খাদিজার বয়স এখন ১৬ বছর। সে এখন নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছে এরমধ্যেই বেশ কয়েকবার বাল্যবিবাহ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় তার খালা-খালু অভাবী সংসারে নিজেদের বাচ্চার পাশাপাশি খাদিজার ভার সহ্য করতে না পেরে লেখাপড়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ঠিক সেই দুঃসময় মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিত‘র প্রতিনিধি এসে পাশে দাঁড়ায় এবং তার বাল্যবিবাহ না দেয়ার ও তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে। সেই টাকার সাথে আর কিছু টাকা যোগ করে একটা গরু কিনে লালন পালন করে কিছুদিন পরে সেই গরুটা লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হলে গরুটা বিক্রি করে আর সেই টাকা দিয়ে খাদিজার খালু ধানের ব্যবসা শুরু করে, ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ ও তাদের সংসারও চলে। এখন খাদিজা সুন্দর ভাবে লেখাপড়া করছে। এত সংগ্রামের পর খাদিজা এখন বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে, তার ইচ্ছে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং বাল্যবিবাহ করবে না। মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি’র প্রতিনিধিরা তাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে খাদিজা।
২/ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বালাটারী গ্রামের নিশরাত জাহান রিমু(১৮)এর কথা। রফিকুল ইসলামের তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে নিশরাত জাহান রিমু রিমু। সে যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী তখন তার বয়স ১৩ বছর। সংসারের অভাব অনটনের কারণে তার বাবা-মা তার বিয়ে দেয়ার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত উপনীত হয়। ঠিক তখনই নিশরাত জাহান রিমু মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি’র প্রতিনিধির মাধ্যমে ফুলবাড়ী যুব মানবসেবা সংগঠনকে অবগত করলে সংগঠনের সদস্যরা তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে বিয়ে বন্ধ করে দেয়। বিয়ে বন্ধ করে দেয়ার পর মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি তাকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে। সেই টাকা দিয়ে সে হাঁস-মুরগি ক্রয় করে এবং হাঁস মুরগির ডিম বিক্রি করে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সে ফুলবাড়ী ডিগ্রী কলেজের আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার ইচ্ছে যেহেতু সে বাল্যবিবাহ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে এখন সে লেখাপড়া শেষ করে একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চায়। সে যুব সংগঠনের একজিন সক্রিয় নেতা হিসাবে কাজ করছে। তার জীবনের অভিজ্ঞতাদিয়ে অন্যমেয়েদেরকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মানষিক শক্তিতে বলিয়ান করছে।
৩/ আবারো বলছি উপজেলার সদর ইউনিয়নের মৃত জমশেদ আলীর মেয়ে কেয়া খাতুন(১৯)এর কথা। সে যখন দশম শ্রেণীতে পড়ে তখন তার বয়স ১৫ বছর। ঠিক তখনই তার বাবা ক্যান্সার রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অভাবী সংসারে মাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে কেয়া খাতুন। সঠিক সেই সময়ে পাশে এসে দাঁড়ায় মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি। তাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেতে তার হাতেও তুলে দেয় ১৭ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তার বাবা রেখে যাওয়া পরিত্যক্ত দোকানে কিছু টাকার মাল কিনে আর কিছু টাকা দিয়ে দুইটি ছাগল কিনে লালন পালন করা শুরু করে। এই ছাগল আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে আর দোকানে বিক্রি করে তার লেখাপড়া সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কেয়া খাতুন এখন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে এবার ভালো কলেজে পড়ার জন্য ভর্তির চেষ্টা করছে এবং লেখাপড়া শেষ করে একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। দুঃসময়ে মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি তার পাশে দাঁড়িয়েছে বিধায় সে আজ আজ বাল্যবিবাহের ভয়ালহাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে।
চাইল্ড, নট ব্রাইট (সিএনবি) প্রকল্পের টেকনিক্যাল অফিসার ইলিয়াস আলী জানান, চাইল্ড নট ব্রাইট (সিএনবি) প্রকল্পটি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি (এমজেএসকেএস) ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী এই তিন উপজেলা ৩০টি ইউনিয়নে কাজ করছে। এই প্রকল্পটির আওতায় মূলত: যারা বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে তাদেরকে নিয়ে আমরা কাজ করছি পাশাপাশি তাদেরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছি তাদের মধ্যে কনফিডেন্স বিলডাফ করছি এবং তাদেরকে ইকোনোমিকাল সহযোগিতা করছি, যাতে করে তারা নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিবাহকে প্রতিরোধ করতে পারে এবং দেশ সমাজ থেকে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে একটা সুন্দর দেশ উপহার দিতে পারে।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোহেলী পারভীন জানান,পারিবারিক অসচেতনতা, অস্বচ্ছতা, সামাজিক দারিদ্রতা ও মোবাইলের ইন্টারনেটের অপব্যবহার এগুলোর কারণে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা বিয়ে পড়াচ্ছে যেমন ইমাম, কাজী, পুরোহিত যাদের রেজিষ্টার বই সঠিকভাবে ব্যবহার করা, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ে সচেতন থাকা, বাল্যবিবাহ রোধে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ করা সম্ভব।
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গুলো গ্রহণ করলে গ্রহণ করলে বাল্যবিবাহ নিরোধ করা সম্ভব। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করা, বিয়ের রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন তৈরি করা, মেয়েদের শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নিরোধ কমিটিকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, প্রহিত,ধর্মীয় নেতা, এনজিও প্রতিনিধি ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ করা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন