বিজ্ঞাপন
শেষরাতের গল্প -ইবনে মিজান
বিজ্ঞাপন
শেষরাতের গল্প
-ইবনে মিজান
কি অইলো মিয়া, আহেন- কাম সারেন! ট্যাকা উসুল কইরা ফুইটা পরেন।
- না, মানে আপনার নাম কি?
অয় মিয়া, নামের লগে কাম করবাইন, নাকি নামের মানুষডার লগে? অত গুজব করবার টাইম নাইক্যা! আহেন!!
- না, মানে- ইয়ে, মানে......!
হা হা হা হা হা....! কী মিয়া, জীবনে পয়লাবার? অত শরমের কিচ্ছু নাই- কাপড়চোপড় খুইলা লুঙ্গি পইরা নেন। শরম কাটানের ব্যবস্থা আমার জানা আছে, মর্দানি বাইর হওনের পর একরত্তি শরম থাইকবে না! বেবাক শরম সমুন্দুরের নোনাপানিতে ধুইয়া দিমুনে। আহেন...
- আসলে যা ভাবছেন, তা নয়! আ-মি ওইসবের জন্যে এখানে আসি নি! আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
হা হা হা....! মিয়ায় কয় কী? পাড়ার মইদ্যে আইছে - কিছু করবার জন্যে লয়! কতা কইবার জন্যি! হা হা হা...
কইত্তে আইছেন? হুনেন মিয়া, গতর বেইচা খাই! খদ্দেরের খুশি দেওয়াই আমার কাম। কইলামই তো, গুজব করনের টাইম নাই! কাম করলে করেন, নইলে ফুটেন!!
- দেখুন, আপনার সময়ের দাম আমি দিয়ে দেবো, আপনার ক্ষতি করবোনা!
অই মিয়া, বেশ্যার লগে ট্যাকার গরম দেহাইতাছেন! যেই বেশ্যাগো ইজ্জতের দাম দেওয়া তোমরা শিখো নাই, তার সময়ের দাম ক্যামনে দিবাইন? হুনেন, বেশ্যা হইবার পারি- কিন্তু, অমানুষ লই! গতর না খাটাইয়া কারুর থেইক্যা ট্যাকাও নেইনা! বুইচ্ছেন?
- দেখুন, আমি একজন নবীন লেখক। আপনাদের জীবনের কাহিনীগল্প লিখতে চাই। আর তাই'ই.....
হা হা হা...! হুনো মিয়া আমাগো ছেঁড়া-ফাটা জীবনের কোনো কাহিনী বা গল্প নাই। কামুক পুরুষেরা নারী শইলের প্রতি আসক্ত। অরা আসে, মজা লুটে, আবার চইলে যায়। পুরুষ; আমাগো এক রাইতের নাগর, যার লগে আমাগো দেহগত বিনিময় হয়। মাইয়াগো ট্যাকা কামানের এর থাইকা সহজ রাস্তা দ্বিতীয়ত আর নাই।
অহন মিয়া, তুমি মজা নিবা, নাকি চইলা যাবা? ফাও প্যাঁচাল পারোনের সময় নাই!
অগত্যা বেরিয়েই এলাম! ওই নারীর কোন গল্প শোনা হলো না!
প্রায় দুইমাস হতে চললো- গান, কবিতা, গল্প কিছুই লিখতে পাচ্ছি না! কেমন যেন ব্লক খেয়ে আছি। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে! ভাবছিলাম এক্কেবারে রিয়েলিস্টিক ঘটনাদি অবলম্বনে কিছু লিখবো। তাই নাম না জানা এই মহিলার কাছে আসছিলাম। কিন্তু, তা আর হলো কই? এখন রাত্রির প্রথমভাগ। ছাত্রবাসে ফিরে যাবো?
নাহ, যাবো না! কিছুই ভাল্লাগছেনা! পাড়া থেকে বের হয়ে জাহাজ কোম্পানি মোড়ের দিকে হাটছি। নিয়নের আলোয় একা পথ চলতে ভালোই লাগছে। কয়েকটা কুকুর জটলা বেধে আছে। দোকানপাট সব বন্ধ, বড়বড় তালা ঝুলছে। তবে এই তালাগুলি নিরাপত্তার সবশেষ কথা নয়! নৈশপ্রহরী বেশ সজাগ, মাঝেমধ্যেই বাঁশিতে ফুঁক দিচ্ছে। কারেন্টের খাম্বায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে শব্দ উৎপাদন করে খানিক বাদে বাদে হুংকার দিয়ে যায়: "ওই, ওদিকে কে রে? কই যায়?"
সে কার উদ্দেশ্যে এইসব হম্বিতম্বি চিল্লাফাল্লা করছে? এটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে, এটুকু বোঝা যাচ্ছে চোরচামকা টাইপের লোকেরা এই হুংকারেই বুঝে যাবে অবস্থা সুবিধের নয়! এইসব দেখে মন্দ লাগছে না। শুনশান নীরবতায় প্রহর পেরিয়ে যায়।
সামনের দিক থেকে একটা রিকশা আসছে। রিকশাচালককে হাঁক ছাড়লাম-
- ওই মামা যাইবা নাকি?
কই যাইবেন?
- কই যাবো? হুম, তাইতো! কই যাবো?
হ্যাঁ, চলো, স্টেশনে চলো। সাতপাঁচ না ভেবেই রিকশায় উঠলাম। রাতের শহর এতটা নিস্তব্ধ হতে পারে! আগে এভাবে দেখা হয়নি। সত্যিই অদ্ভুত! রিকশার হুডে ধ্যাপ ধ্যাপ টাইপের শব্দ হচ্ছে। শিরশির করে বয়ে চলেছে হাওয়া, শরীর ছুঁয়ে যায়। শহরটা যেন আজ আমার একার সম্পত্তি! আমিই আজ এই শহরের একচ্ছত্র অধিপতি! আর রিকশাচালক? সে আমার সেনাপতি। হঠাৎই রিকশাটা গ্রান্ড হোটেল মোড়ে ব্রেক দিলো। রাস্তার অপরপ্রান্তে পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো। একজন পুলিশ রিকশাচালককে ইশারা দিয়ে থামিয়েছে। বললো-
* ওই রিকশা কই যায়?
মামায় স্টেশন যাইবে, স্টেশন যাইতেছি স্যর।
রিকশাচালকের কথা শেষ না হতেই দুইজন পুলিশ রাস্তা পার হয়ে রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন পুলিশ আমাকে বলল-
* বাড়ি কোথায়?
আমি কিছু বলছি না! চুপ করে থাকলাম।
* ব্যাগে কী আছে?
আমি এবারো চুপ!
দ্বিতীয়জন পুলিশ এবার সামনে এলো - ধমক দিয়ে বলছেন:
* ওই, কথা কানে যায়না! কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
এবার আমি দ্বিতীয়জনকে উদ্দেশ্য করে বললাম -
- আপনার আই কার্ড দেখান।
* এই কেন, আই কার্ড কেন?
- আপনি আসল পুলিশ নাকি নকল? সেটা বুঝতে হবে তো! বুঝতে হবে না? আরে, আসল পুলিশ তো কখনোই তুইতোকারি করে না! আপনার আই কার্ড দেখান।
এবার প্রথম পুলিশ সামনে এলো -
* পুলিশের সাথে মশকরা হচ্ছে?
- ভুল বুঝবেন না! আজ সকালেই টিভিতে দেখলাম, ভুয়া পুলিশের খপ্পরে পরে ব্যবসায়ী গুম! সন্দেহ অমূলক নয়।
দুই পুলিশের সাথে কথা চলছিলো এমন সময় আরেকজন পুলিশ মোটরবাইক নিয়ে একদম রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালো - এসেই আমার সামনে উপবিষ্ট দুই পুলিশকে জিজ্ঞেস করেন...
* এই, কি হয়েছে এখানে?
প্রথম পুলিশ তাকে সব খুলে বলছিলো। এদিকে আমার কেনজানি বাইকে আসা তৃতীয় পুলিশটাকে চেনা চেনা লাগছে! দ্বিতীয় পুলিশের হাতে থাকা টর্চ লাইট চেয়ে নিয়ে এই নতুন পুলিশের চোখেমুখে আলো ধরলাম!
এ দেখে প্রথম পুলিশ তেড়ে এসে বলছে- "এই, তোর এতবড় সাহস!"
ওর কথা শেষ না হতেই আমি বললাম -
- রন্টু মামা! তুমি কোতোয়ালি থানায়! কবে আসছো? আরে মামা আমি মিল্টন মামার ভাগ্নে, তোমার সাথে ঢাকায় দেখা হয়েছিলো, মামার বাসায়, মিরপুর ১০ নম্বরে!
টর্চের আলো এবার নিজের মুখের দিকে ধরে বললাম--
- দেখো তো মামা চিনতে পারো কি?
হটাৎ করেই উনার চোখেমুখে আলো ধরাটা রীতিমতো আহাম্মুকে ব্যাপার হয়ে গেছে। অবস্থা বুঝেই আলো নিভিয়ে ভদ্রোচিত নম্র গলায় বললাম : মামা, আমি নিজাম! সুরভী মামীর ভাগ্নে, সুরভী মামী; তোমার বোন! আমাকে চিনতে পাচ্ছো না?
পুলিশটি আমাকে চিনতে পারলেন না! বললেন - "আপনাকে চিনতে পাচ্ছিনা! সুরভী; এই নামে আমার কোনো বোন নাই আর আমিও আপনার রন্টু মামা নই, আপনার ওই মিল্টন মামাটা কে!?"
আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকায় পরে গেলাম! শুনেছিলাম পুলিশের চোখ কখনো ভুল দেখে না! তাহলে কি আমিই ভুল লোককে রন্টু মামা ভাবছি? রন্টু মামার সাথে একবারমাত্র দেখা হয়েছিলো, ছোটমামার বাসায়, যখন আটানব্বই সাল! তাছাড়া এই পুলিশের নেমপ্লেটে লেখা রাইসুল আজাদ। আমি শুধুমাত্র রন্টু মামার ডাকনামটাই জানি! আরে না, না! এই লোক রন্টু মামা নয়! তাছাড়া, তিনি যখন বলছেন যে আমাকে চিনতে পাচ্ছেন না, সেখানে আর কী করার!? আর ইনি রন্টু মামা হলে আমাকে অবশ্যই চিনতেন!
তাকে বললামঃ
- আপনি রন্টু মামা নন! বে-শ ভালো কথা। মিল্টন নামের ব্যক্তি আমার ছোটমামা, সম্পর্কে তিনি আপনার দুলাভাই, আর আমার হবু শ্বশুর হবার কথা ছিলো! দুর্ভাগ্য, একটাও হলো না! সে যাইহোক, এবার আমাকে যেতে দিন।
* যাবেন, অবশ্যই যাবেন, তার আগে বলুন- কোথা হতে আসছেন?
- শিউলিবাড়ি থেকে
* শিউলিবাড়ি! ওটাতো বেশ্যালয়!
- জ্বি, ওটা বেশ্যালয়।
* কেন গিয়েছিলেন সেখানে?
- আরও দশজন যে কারণে যায়! সত্যিই, আপনার আই কার্ড দেখা উচিৎ, পুলিশ কখনো এরকম বোকাবোকা প্রশ্ন করে নাকি? আশ্চর্যের ব্যাপার!
খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বললাম। কিন্তু, উপস্থিত কেউই সহজভাবে নিলো না! ওদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে যেন আমার শরীর থেকে পচা মাছের আঁইশের উৎকট গন্ধ বেরুচ্ছে। ঐ শিউলিবাড়ি নামটা মুখে তোলামাত্রই এই দুর্গন্ধটা শুরু হলো! অথচ, কিছুক্ষণ আগেও এরকম কারোর ইন্দ্রিয় স্পর্শ করেনি! দ্বিতীয় পুলিশটি ঘৃণাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললোঃ
* ছিঃ ছিঃ! কি জঘন্য এই সময়ের পোলাপান! ঘোর কলিযুগ স্যর, ঘোর কলিযুগ!
ওর কথায় কর্ণপাত করে এবার রাইসুল আজাদ আমাকে বললেন ঃ
* এখন কোথায় যাচ্ছেন?
- রেল স্টেশন।
* কেন?
- প্লাটফর্মে বসে থাকবো
* প্লাটফর্মে বসবেন কেন?
- প্রাইভেট বিষয়! বলা যাবেনা!!
* এখানে কোথায় থাকেন?
- মেসে থাকি, মেস লালবাগ ২নং রেলগেটে, রাতিন স্টুডেন্ট প্যালেস।
* কোন কলেজ?
- কারমাইকেল
* আই কার্ড!?
- এইযে দেখুন! (দেখালাম)
* ব্যাগে কী আছে?
- বলা যাবেনা!
* বলা যাবেনা কেন?
- ব্যাগের সবকিছু আমার, এখানে প্রাইভেসি একটা ম্যাটার! ফাঁস করা যাবেনা, ফাঁস করলে আবার কলিযুগ শুরু হতে পারে!
* পুলিশের সামনে কোন প্রাইভেসি চলে না! সে যাইহোক ব্যাগটা দিন।
- আপনি নিজের জায়গায় থাকুন, আমি নিজেই সবকিছু বের করছি।
* আচ্ছা, বের করুন।
প্রথম পুলিশটি আমার দিকে টর্চ ধরলেন। ব্যাগটা ঘাড় থেকে নামিয়ে হাঁটুর উপর নিলাম।
রিকশাচালকের মুখটা বেশ উজ্জ্বল, ভাবসাবে সে আমার লোক। আর পুলিশ তিনজনই তীক্ষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন- কী বেরুচ্ছে ব্যাগ থেকে?
তিনটা ডায়েরী, একটা মেডিসিন প্যাড, দুটো কলম, এক প্যাকেট জন প্লেয়ার, একটা লাইটার। এ-সব বের করে রিকশার সিটে রাখলাম। এতক্ষণ সবকিছু ঠিকই ছিলো। সবশেষ যখন একটা স্কচ মদের বোতল বের করে সামনে ধরলাম। তখন পুলিশদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো! অন্যদিকে রিকসাচালকের চোখমুখ যেন চৈত্রের কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে গেলো! তৃতীয় পুলিশ, রন্টু মামা নন, রাইসুল আজাদ; তিনি আমার ডায়েরীগুলো হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করলেন। এদিকে প্রথম পুলিশটি দাতমুখ খিঁচিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন-
* ওওওও, এইজন্যে আই কার্ড দেখতে চাও! চোরের মায়ের বড়গলা! এইবার বুঝবা বাছাধন, কয় মাঘে শীত যায়?
স্বভাবজাতভাবে বললাম ঃ
- আমি চোর নই! এটা অনুমোদিত আর আমি ভ্যাট দিয়ে সরকারি বার থেকে নিয়েছি, এইযে দেখুন রশিদ। আর ঐ কালোবাজারের মদ? আমি খাইনা!
এবার তিনি বলেন:
* হাফ বোতল মদ, বাকী অর্ধেক কই?
- জ্বি, বাকী অর্ধেক ১৪ নম্বর গোডাউনে জমা করা হয়েছে!
* ১৪ নম্বর গোডাউন! সেটা কোথায়!?
- সেটা জানলে তো আর এই বয়সেও কনস্টেবল থাকতেন না! সোজা ওসির চেয়ারে বসে যেতেন। নিয়মিত মদ খান- মাথা খুলে যাবে!!
ওদিকে ডায়েরী দেখতে দেখতে হঠাৎই তৃতীয় পুলিশটি কেমন যেন হয়ে গেলেন! মনে হচ্ছিলো ঘটমান বিষয়াদি ওনার ভাল্লাগছেনা! ডায়েরীগুলি আমাকে ফেরত দিলেন আর চরম বিরক্তি নিয়ে দ্বিতীয় পুলিশটিকে বললেন:
* মঈন সাহেব, ওর নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর নিয়ে ছেড়ে দিন। আর হ্যাঁ, কাগজে স্বাক্ষর নেবেন।
বলেই তিনি বাইক স্টার্ট করে সেভাবেই চলে গেলেন, যেভাবে এসেছিলেন। এবার দ্বিতীয় পুলিশ, মানে মঈন সাহেব তার কর্তব্যপালনে ব্যতিব্যস্ততা দেখানো শুরু করে কাগজকলম হাতে নিলেন, কিছুটা কর্কশ সুরে আমাকে বললেনঃ
* নাম কি?
- নিজাম
* নামের আগে পিছে কিছু নাই!?
- না, নেই।
*
-
একের পর এক তথ্য নিয়ে কাগজটিকে সাদাকালো বানিয়ে তিনি আমার সামনে ধরলেন স্বাক্ষরের জন্য। কাগজটি ফিরিয়ে নিতে নিতে কিছুটা রিল্যাক্স মুডে বললেনঃ
* মদ খাওয়া হারাম, জানো না?
-জ্বি, জানি!
* জেনেশুনে হারাম খাও কেন?
- ঘুষ খাওয়া হারাম! এইটা জেনেবুঝেও পুলিশ যেকারণে ঘুষ খায়, সেকারণে আমিও মদ খাই!
একথা শোনার পরে উনি আর দাঁড়ালেন না। রিকশাওয়ালাকে বললেন: "এই, এরে স্টেশন নিয়া যা, ঘোর কলিযুগ শুরু হইছে"
রিকশাচালক প্যাডেল মারতে শুরু করলেন। তিনি প্যাডেল মারার ফাঁকে ফাঁকে পেছন ফিরে আমাকে দেখছেন...বুঝতে পেরে বললাম - মামা, কিছু বলবেন?
♪ না, মামা তেমন কিছু না, একনা কথা কবার চাই! যদি কিচু মনে না করেন!
- মদ খাবেন?
♪ হে হে হে, হয় মামা, জেবনেও খাই নাই! আইজ একটু খাবার মন চাইছিল আরকি। তা মামা, আমার মনের চাওয়া কেমন করিয়া বুঝলেন?
চুপ করে থাকলাম, আর কিছু বললাম না। গন্তব্য? রংপুর রেলস্টেশন। জ্যোৎস্নাময় রাত, এগিয়ে চলছি। শিরশির বইছে হাওয়া। শাপলাচত্বর আসতেই চোখ পরে গেলো বা দিকের রাস্তাটায়। তিন চারজন লোক জটলা বেধে কি যেন করছে। স্পষ্ট দেখা গেলো না! শাপলা সিনেমা হলের বিশাল পোস্টার ঝুলছে, এতরাতে কেউ আগে সিনেমার পোস্টার দেখেনি! রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। সে রিকশা থামালে স্কচের বোতলটি বের করে কিছুটা গলায় ঢেলে বাকীটা ওর হাতে দিলাম।
সিনেমার পোস্টার দেখার মধ্যেও একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।
এখন মধ্যরাত, রিকশা চলছে। ট্রাক স্ট্যান্ড পার হয়ে খামার মোড়ের দিকে এগুচ্ছি। দুইদিকে ছোট আর মাঝারি বিল্ডিং। ঢাকা শহরের মত অত বড়বড় বিল্ডিং, রাস্তা, ইমারত, কারখানা এখানে নির্মিত না হবার কারণ কী? ধুর, এতরাতে শহর পরিকল্পক হবার আমার কী দরকার? এরা গরীব, তাই পারে না, পারে নাই আর ভবিষ্যতে অবস্থা পরিবর্তিত হবে এনিয়েও সন্দেহ নাই।
রিকশাটি; স্টেশন রোডে চলছে, রাস্তাটা বন্ধুর। ধ্যাপ, ধ্যাপ, লক্কড়, ঝক্কড় শব্দে এগিয়ে যাচ্ছি -নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি? বুঝতে পাচ্ছি না! চাঁদ আর জোসনা একচুলও নড়ছে না, দুজনে লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে, চলছে আমার সাথেই।
চলন্ত রিকশায় সিগারেট টানার ব্যাপারটা আসলেই অন্যরকম। তার উপর পূর্ণিমারাত, জনশূন্য রাস্তা, নিস্তব্ধতার গহীনে ঘুমন্ত শহর, ল্যাম্পপোস্টে বাতিগুলো জ্বলছে- আর আমি পায়ের উপর পা রেখে সিগারেট টানছি! সবমিলিয়ে একটা রাজকীয় অনুভূতি। এমন সময় রিকশা থামিয়ে তড়িঘড়ি করে নেমে- গড়গড় করে বমি করে দিলেন রিকশাচালক! বমির উৎকট গন্ধ নাকে লাগতেই রিকশা থেকে নেমে পড়লাম। আমার রাজকীয় মুডের মায়রে বাপ অবস্থা হয়ে গেলো! রাস্তার পাশের নলকূপের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে এসে রিকশাচালক বলছে-
- ' মামা, আইজকায় জীবনের পেতথোমবার বিদাশী মদ খাইচি তো, প্যাটে সয় নাই, বমি হয়া এক্কেরে সব ব্যারে গেলো! কিচু মনে করেন না মামা, ওটেন, গাড়িত ওটেন'। কিছু না বলে রিকশায় উঠে বসলাম।
কিছুদূর এগিয়ে রিকশাচালক বলছে,
- মামা, আমি মুক্কুসুক্কু লোক ! কতা কইলে ভুল হয়া যাইতে পারে! যদিকাল কিচু মনত না নেন- তাইলে একনা কতা জিজ্ঞাস কইরবার চাই।
♪ কি জিজ্ঞেস করতে চাও মামা!? বলো, আমি কিছু মনে করবো না।
- হে হে হে মামা, এত রাইতোত ইস্টিশন যাবার ধইরচেন! নিচ্চয় কোন কারণ আছে?
♪ হুম, আছে, কারণ তো কিছু একটা আছেই
- আমি বুইঝবার পারচি মামা, কী কারণ!
♪ কি বুঝেছো?
- হে হে হে... মাগি খুঁইজবার জন্যে যাবার ধইরচেন, তাই ন্যা মামা!?
♪ কিভাবে বুঝলে?
- মদ খাইচি তো মামা, বেরেনের সবকয়টা দুয়ার খুলি গেইচে! হে হে হে...।
রিকশাচালকের কথা আর হাসির ধরণ দেখে মনে হলো সে আমাকে মদখোর, মাগিবাজ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে! তার কথা শুনতে ভাল্লাগছে না! যদিও বলেছিলাম তার কথায় কিছু মনে করবো না, তবুও কিছু একটা মনে করেই ফেললাম! রিকশাটা স্টেশনের সামনে দাঁড়াতেই ওকে ছেড়ে দিলাম।
জোর খিদে পেয়েছে, প্লাটফর্মের ভেতরে দুটি চায়ের দোকান। এর একটিতে আমি প্রায়শই রাতে চা খেতে আসি, অন্যটিতে কখনো বসা হয়নি! কেন হয়নি!? সেটা জানিনা!!
দুইটা ড্রাই কেক, একটা কলা দিয়ে মাঝরাতের ভোজন শেষে এক কাপ চা, চায়ের সাথে সিগারেট, মনে হচ্ছে রাজভোগ!
একটা মেয়ে, পড়নে ময়লাটে সালোয়ারকামিজ, চুলগুলো রুক্ষ, কোটরাগত চোখের নীচে কালি পড়েছে! কতবছর ঘুমায় নি!? কে জানে? মনেহয় এইমাত্র কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশভ্রমণ করে এলো! তবে শরীরেরগাঁট আছে। পাঁচ টাকা দামের একটি পাউরুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে মেয়েটি। আমি তার পিছু নিলাম। নগ্ন পায়ে বিধ্বস্ত শরীরটাকে জোর করে সামনের দিকে টেনে নিয়ে পুরাতন প্লাটফর্মের শেডের আবছা আলোয় বসে কাগজে মোড়ানো পাউরুটি খেয়ে মসজিদের ওযুখানার কলে পানি পান করে আবার একই জায়গায় ফিরে আসলো। মসজিদের পানি শুধু ওযুর জন্য নয়, পান করাও যায়। অন্য ধর্মের লোকেরাও এখানে পানি পান করে কি? এই মেয়েটিই বা কোন ধর্মের!?
মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। ওর সামনে দাঁড়াতেই বললো-
- কাম করবেন নাকি চোষানি!? কামের এক সটে ১০০, আর চোষানি ৫০।
♪ না, না! ওসব কিচ্ছু নয়, আপনার সাথে কিছু কথা বলবো। বিনিময়ে আপনার সময়ের দাম দিয়ে দেবো!
- কতা কইবেন, আর তার জন্ন্যে টাকাও দেমেন! বুইচ্চি আপনে ভালে মানুষ। তা কি কতা কইবেন!? মোর নাম কি, বাড়ি কোন্ঠে, এই লাইনত কেমন করি আইসলাম!? এইগুলাইতো!? এইগুলা কতা না ভাইজান- জেবনের ইতিহাস-
শোনেন ভাইজান, মোর নাম হাসি! বাড়ি লালমনিরহাট। মোর বয়স যকন ১৫ বচর, তকন মোর আপন মামা ফুসলিয়া ফুসলিয়া কাম করি প্যাট বানে দিচিলো! জানাজানি হবার ভয়ে মামা রমপুর আনিয়া ছাওয়া নষ্ট করি দেচে! তারপর মামার বন্দুর বাসাত কাজ দেচেলো, মামার বন্দু আর বন্দুর ব্যাটাও তিনটা বচর যা কইরবার তা কইরচে! মামাও মাজেমধ্যে আসিয়া খবর নিয়া যায়। কেমন করিয়া আবার প্যাট হয়া গেলো! মামার বন্দু ঔশদ দিয়া ছাওয়া নষ্ট করে দিবার পর যখন জানিবার পাইলো যে তার ব্যাটাও আমাক কাম করে! তখন বাড়ি থাকি বাইর করি দেচে! ওদি ফের আমার বাপটাও মরি গেলো! কোনটে যাবার জাগা নাই, কাওয়ো ফেরিতে ভাত না খোয়ায়! সবায় খালি দেহাটা চায়। তা যকন বুঝিবার পানু যে, মোর দেহাটার দাম আচে! তকন থাকিয়া দেহা ব্যাচেয়া খাই। এই হইল মোর কথা, আর কিছু কবার পাইম না! এলা ৫০টা টাকা দিয়া সারি যাও, কাশটোমার উলুকভুলুক কইরবার ধইরচে!"
ওর কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলাম না!
প্লাটফর্মের মাঝামাঝি স্থানে যাত্রীদের বসার জন্য এখানে একধরণের ফিক্সড চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। একসাথে বারোটি চেয়ার- বেশ চমৎকার এবং আরামদায়কও বটে। এখানেই বসে পড়লাম। বামদিকে মাথা ঘুরালেই মেয়েটাকে দেখা যায়। আমার সামনে তিনটি রেললাইন, তিন নম্বর রেললাইনের ওপর লালরঙের তিনটে মালগাড়ী। প্রথম দুটো ট্রাক, তৃতীয়টি বাসের মত, তবে জানালা নেই, শুধু দরজা আছে! দরজাটা খোলাই! কিন্তু, ভেতরটা দেখা যায়না! চাঁদের আলোতে ইঞ্জিন বিহীন মালগাড়িগুলো দেখতে এতিমের মত মনেহয়! রেললাইনের ওইপাশে একটা মাঠ, মাঠের শেষে রাস্তা, গাছ, ল্যাম্পপোস্ট, ডানে বায়ে বড়বড় দুটি বিল্ডিং, বিল্ডিং ঘিরেছে বাউন্ডারি ওয়াল। একটি ওয়ালে বড়করে চিকামারা,
"নৌকা লাঙ্গল ধানেরশীষ,
সকল সাপের একই বিষ!"
বসেবসে এসব দেখছিলাম আর ঐ মেয়েটার কথা ভাবছিলাম। তার নিজের মামা, মামার বন্ধু, বন্ধুর ছেলে, এবোরশন.....!
খানিক বামদিকে মাথা ঘোরাতেই দেখি, মেয়েটা রেললাইনের দিকে, তার পেছন পেছন দুজন যুবক। ওরা তিন নম্বর রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দরজাযুক্ত মালগাড়িটির কাছে গেলো। ছেলেদুটো মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে মালগাড়ীতে উঠিয়ে দিয়ে নিজেরাও উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলো! দরজাটা খোলাই আছে, তবু ভেতরকার কিছুই দেখা যাচ্ছেনা, ভেতরে আলো নেই!
মিনিট বিশেক পর যুবক দুজন একএক করে লাফিয়ে নামলো, আর নেমেই উল্টোদিকে ভোঁ দৌড়! মালগাড়ীর ভেতর থেকে মেয়েটি চেঁচিয়ে বলছে, -
-'ওই কুত্তার বাচ্চারা, আমার টাকা দিয়া যা। টাকা না দিয়া তোয়ার মা'র সাথে কাম করলিরে শুয়োরের বাচ্চারা, মাগির টাকা না দিয়া পালাইস! আল্লাহ তোদের বিচার করবে! তোদের ধোন খসি পড়বেরে মাগির বাচ্চারা!"
মেয়েটির চেঁচামেচি শুনে কোথা হতে একজন রেলওয়ে পুলিশ দৌড়ে এলো। এসেই শাসাচ্ছে-
- আজ এই প্রোস্টিটিউট মাগির পিঠের চামড়া তুলে নেবো! এতবার নিষেধ করার পরও স্টেশনে ব্যবসা করছে! "
পুলিশটি এক হাতে লাঠি আর অন্যহাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে কথাগুলি বলতে বলতে হাসিকে ধরার জন্য তিন নম্বর রেললাইনের দিকে দ্রুতপায়ে যাচ্ছেন। ওদিকে মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে মালগাড়ী থেকে নামতে গিয়ে ধপাস করে মুখথুবড়ে পড়ে গেলো। সে উঠে পালাবার আগেই পুলিশটি তার কাছে পৌঁছে গিয়ে বলছে-
- এই বেশ্যামাগি, উঠ, উঠে দাঁড়া, এই ডান্ডা আজ তোর... য়ার ভেতর ঢুকিয়ে তোর সব সাধ মিটিয়ে দিয়ে- তারপর থানাপুলিশে খবর দিবো। এই বেশ্যামাগি, কুকাম করার জন্যে দুনিয়ায় আর জায়গা পাস নি! উঠ, এই উঠে দাঁড়া! তোকে আজ......... "
পুলিশটি বকে চলেছে অথচ মেয়েটি মাথা তুলছে না! পুলিশটি রেগে গিয়ে মেয়েটির শরীরে লাঠি দিয়ে গুঁতো মারলো, তবুও মেয়েটা নড়ছে না! এবার পুলিশটি চেঁচিয়ে উঠলো -
- এই, একিরে! এর মাথাতো পাথরে পড়ে ফেটে গেছে! হায় হায়... এখন কী করি!?'
আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করলাম-
♪ কী হয়েছে মেয়েটার?
- আরে ভাই, এটা মেয়ে না! এটা একটা বেশ্যা!
♪ দেখুন তার মাথা ফেটে গেছে, হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করুন। নইলে মরে যাবে, আর মরে গেলে আপনাকেই জবাবদিহি করতে হবে!
- তা ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছে....ন"। মুখের কথা শেষ না হতেই তিনি স্টেশনমাস্টারের অফিসকক্ষের দিকে মুখ ফিরিয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন -
- এই মদন লাল, এই মদন লাল! মদন লাল!
ওদিক থেকে জবাব এলো - হা বাবু,.. হামি আছি বটে...!"
মদন লাল দৌড়ে এসে মেয়েটিকে উল্টিয়ে নিয়ে নাড়ীটীপে ধরলো। একবার ডানহাত আরেকবার বামহাত টিপে ধরলো। কিছুক্ষণ নাড়ীটেপার পর উঠে দাঁড়িয়ে বললো-
- হাজুর, ইয়ে ভ্রষ্টাচারী মাগিতো মারা গিয়া, ইহার নাড়ি খুঁজিয়া পাইতেছিক লাই! ইয়ে ছিনালী মারা গিয়া হাজুর!!"
পুলিশটি বললো-
* এই শালি মরে নাই, মরে নাই- মদন লাল! বলো যে, মরে গিয়ে বেঁচে গেছে!
আমি ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললাম -
♪ মেয়েটির নাম হাসি। বলুন- হাসি মরে নি, তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে! আর খুনটা আমরাই করেছি!! এটা একটা ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ড!
শেষবারেরমত হাসির মুখের দিকে চেয়ে দেখার সাহস হয়নি আমার। রাতের আধার আলোকছটা দেখে ভোর হতে চললো, ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। রেললাইনের পথ ধরে হাটতে হাটতে একটা কথা বারবার মনে পড়ছিলো-
" যেই বেশ্যাগো ইজ্জতের দাম দেওয়া তোমরা শিখো নাই, তার সময়ের দাম ক্যামনে দিবাইন!?
(সমাপ্ত)
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন